কৃষির চেহারা পাল্টে দিয়েছে ৬ শতাধিক নারীরা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের ৬ শতাধিক গৃহবধূ সম্মিলিত ভাবে যা করছেন, তা এলাকার কৃষির চেহারা পাল্টে দিয়েছে। নিজেদের তৈরি কম্পোস্ট সার দিয়ে নিজেরাই সবজির চাষ শুরু করেছেন এই নারীরা। তাতে শুধু অরগানিক বা বিষমুক্ত সবজিই পাওয়া যাচ্ছে না, দারিদ্র পীড়িত এলাকাটির ২৪টি গ্রাম থেকে বিদায় নিয়েছে অভাব-অনটন। এখানকার সবজি এলাকা ছাড়িয়ে রাজধানীতেও পাড়ি জমাচ্ছে।কৃষিকাজে নিয়োজিত এই গৃহবধূদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ইউনিয়নের ১৩ জন নারী বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ‘জয়ীতা’ নির্বাচিত হয়েছেন। একজন পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক। শুরুতে কৃষিকাজে স্বামীদের সহায়তা করতে বাড়ির আঙিনায় সবজির চাষ শুরু করেছিলেন এই গৃহবধূরা। তারপর ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত জমি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফসলি জমিতেও এই চাষ ছড়িয়েছে।কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম বলেন, এই নারীদের জন্যই এখন এলাকার লোকজন বিষমুক্ত সবজি খেতে পারছেন।

স্বামী-স্ত্রী দুই রকম চাষ

গ্রামের আবদুস সাত্তার অন্যদের মতোই রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে চাষাবাদ করেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা খাতুন করেন বিষমুক্ত সবজির চাষ। বাড়ির আঙিনা, পার্শ্ববর্তী খেতে, পরিত্যক্ত জমি চাষযোগ্য করে সেখানেই এই আবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন মনোয়ারা। কেঁচো সার, গাছের পাতা থেকে তৈরি বালাইনাশক ব্যবহার করছেন ফসলের খেতে। ইতিমধ্যে বিভাগীয় পর্যায়ে জয়ীতাসহ একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।পাশের গ্রামের মাজেদা খাতুনের স্বামী সামছুল ইসলামও কখনো ভাবেননি তাঁর স্ত্রী এভাবে নিজ এলাকায় বিষমুক্ত সবজির বিপ্লব ঘটাতে পারবেন। এখন তাঁরা পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে সপ্তাহে দুই দিন দেশের বিভিন্ন জেলায় সবজি পাঠাচ্ছেন। সামছুল ইসলাম এখন নিজেও রাসায়নিক সার-কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন।

যেভাবে শুরু

নিয়ামতপুর ইউনিয়নের ২৪টি গ্রাম বরাবরই ছিল দারিদ্র পীড়িত। ২০০৫ সালে হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ড নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে নারীরা নেমে পড়েন বিষমুক্ত সবজির চাষে। উদ্দেশ্য ছিল সংসারে বাড়তি কিছু আয়।কৃষিবিজ্ঞানী গুল হোসেন ২০০২ সালে এই ইউনিয়নের বেশ কিছু নারীকে কেঁচো দিয়ে কম্পোস্ট সার তৈরির প্রশিক্ষন দেন। পরে সাংগঠনিক পর্যায়ে কাজ করার সময় এই প্রশিক্ষন সহায়ক হয়েছে। নারীরা সার তৈরির পাশাপাশি নিজেরাই কৃষি কাজে নেমে পড়েন।একাধিক নারী বলেন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ড ২০০৫ সাল থেকে তাঁদের নিয়ে কাজ শুরু করলেও বিষমুক্ত সবজির চাষ শুরু হয় ২০১১ সালে। বাড়ির আঙিনায় কীভাবে এই সবজির চাষ করা যায় তা নিয়ে কাজ করতে থাকেন। নারীরা একত্র হয়ে ভার্মি কম্পোস্ট ও বালাইনাশক তৈরির প্রশিক্ষন নেন। পাশাপাশি বাড়ির আঙিনা, পার্শ্ববর্তী খেত ও অনাবাদি জমি চাষযোগ্য করে বিষমুক্ত সবজির চাষ করতে থাকেন। নিয়ামতপুর ইউনিয়নের বাড়িতে বাড়িতে এখন এই তৎপরতা চোখে পড়ে। স্থানীয়ভাবে বিক্রি ছাড়াও সপ্তাহে দুই দিন তাঁরা দুই ট্রাক সবজি জেলার বাইরে পাঠাচ্ছেন।হাঙ্গার ফ্রি ওয়াল্ডের কর্মসূচি কর্মকর্তা এস এম শাহিন হোসেন বলেন, নারীদের স্বাবলম্বী করতে তাঁরা নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন। তারই একটা ছিল বিষমুক্ত সবজির চাষ। আর এই চাষ করতে বাড়িতে কেঁচো সার ও বালাইনাশক তৈরি করা।

পদক ও স্বীকৃতি

কালীগঞ্জের মহেশ্বরচাঁদা গ্রামের মর্জিনা খাতুনের দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে সংসার। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর বাবা ওমর আলীর বাড়িতেই থাকেন। তিনি জানান, একসময় খুবই অভাবের সংসার ছিল তাঁদের। ২০০২ সালের পর পুরুষের পাশাপাশি তাঁরা নারীরা কৃষিকাজে এগিয়ে আসেন। ২০১১ সাল থেকে তাঁরা বাড়ির আঙিনায় সবজির চাষ করছেন। বর্তমানে তাঁর বাড়িতে প্রায় ৭০০ চৌবাচ্চায় কেঁচো সার তৈরি হয়। মাসে চার টন সার বিক্রি করছেন তিনি, যার বাজারমূল্য প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এই সার বিক্রি করে তাঁর ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। ২০১৭ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক পেয়েছেন।মস্তবাপুর গ্রামের গৃহবধু মনোয়ারা খাতুনের স্বামী আবদুস সাত্তার অন্যের জমিতে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। এই আয় দিয়ে সংসার চলত না। বিষমুক্ত সবজির চাষ করে তাঁদের সংসারে সচ্ছলতা এসেছে। দুই বিঘা জমি কিনেছেন। বাড়ি পাকা করা হয়েছে। বাড়িতে বায়োগ্যাস রয়েছে। ইতিমধ্যে বিভাগীয় পর্যায়ে জয়ীতা নির্বাচিত হওয়াসহ ছয়টি বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রনি লস্কর বলেন, এই নারীরা গোটা ইউনিয়নের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। তাঁদের কাছ থেকে তিনি নিজেও বিষমুক্ত সবজি সংগ্রহ করেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর